Biography of Sufi Saint Abu Ali Akter Uddin

চিরঞ্জীব সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দিন

Faridpur Sharif
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সমগ্র ভারতবর্ষের মতই বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে ছিল এক সংকটময় কাল। মুসলমানদের মধ্যে দু’টি পরস্পর বিরোধী ভাবধারা গড়ে উঠতে থাকে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ পাশ্চাত্য ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্ম সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে পড়ে। অপরদিকে একদল আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষা চর্চা করে জীবিকা অর্জনের জন্য কোন সুবিধাজনক পথ না পেয়ে ইসলামের বিধানসমূহকে পার্থিব উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। এই অবস্থায় ইসলামের অবক্ষয় রোধে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদেরকে আল্লাহ্র পথে ডাক দেবার জন্য এবং স্বার্থান্বেষী আলেম সম্প্রদায়ের মুখোশ সাধারণ মানুষের কাছে উন্মোচন করার জন্য এই অঞ্চলে একজন সঠিক পথপ্রদর্শকের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ইসলামের উজ্জ্বল তারকা হিসেবে বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর থানার ব্রহ্মপুত্র নদীর কিনারে ফরিদপুর নামক এক নির্জন গ্রামে আল্লাহর হুকুমে আবির্ভাব ঘটে সূফী সাধক আক্তার উদ্দীন-এঁর।
বিভিন্ন দরবারে, অগ্রহায়ণ মাসে সূফী সাধক আক্তার উদ্দীন এঁর আবির্ভাব দিবস পালন করা হয়। তাঁর জন্ম সন নিয়ে মতভেদ আছে, তবে যতদূর তথ্য পাওয়া যায় ১৮৭২ সন হতে ১৮৭৫ সনের মধ্যে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন মরহুম মোজাফ্ফর সরকার। তিনি একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সূফী সাধক আক্তার উদ্দীন ছিলেন সবার বড়। বাল্যকালে অতিশয় আদর ও যত্নে লালিত-পালিত হয়েছেন। তখন থেকেই তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও ভাবুক প্রকৃতির।
গ্রামে তাঁর সমবয়সীদের সাথে বেশি মেলামেশা না করে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে আরম্ভ করেন। তাঁর পিতা সন্তানের এই অবস্থা দেখে নরসিংদী জেলার গকুলনগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ভূঁইয়া বাড়িতে জনাব আলী ভূঁইয়ার মেয়ের সাথে বিবাহ দেন। বিবাহের পরবর্তীতে তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু শৈশবেই এক মেয়ে ও এক ছেলে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এবং এক মেয়ে তাঁর ওফাতের প্রায় দুই বছর আগে বিদায় নেন। সন্তান জন্মের পর সাধারণত মানুষ বেশি উৎসাহ নিয়ে সম্পদশালী হতে চেষ্টা করে কিন্তু সূফী সাধক আক্তার উদ্দিন ছিলেন ঠিক তার উল্টো। সাংসারিক জীবন তাঁর নিকট অর্থহীন ও উদ্দেশ্যবিহীন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
শৈশবে কুলিয়ারচর থানার ওসমানপুর নামক গ্রামে ওসমানপুর মক্তবে (বর্তমান প্রাইমারী স্কুল) প্রাইমারী শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর তৎকালীন আসাম প্রদেশের (বর্তমান সিলেট জেলা) এক মাদ্রাসায় কিছুদিন শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায়। তিনি এনট্রান্সও পাশ করেন। অতঃপর তিনি সাব রেজিষ্ট্রার পদে চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু চাকরি ও দুনিয়াদারীর মোহ তাঁকে আকৃষ্ট করতে না পারায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মুসাফির জীবনকে বেছে নিয়ে বিভিন্ন দরবার, মাজার ও আস্তানা শরীফে ঘুরে বেড়ান। তিনি মিরপুর শাহ্ আলী বোগদাদী (র.) এঁর মাজার শরীফে বেশ কিছুদিন কাটান তবে উল্লেখযোগ্য সময় কাটান নারিন্দার শাহ্ আহসান উল্লাহ্ (র.) এঁর দরবারে। এখানে তিনি ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন শিক্ষকতায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কিন্তু শিক্ষকতাও তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেনি। আবার মুসাফিরের জীবন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি উপমহাদেশের সূফী সাধনার মহীরূহ হযরত আজান গাছী (র.) এঁর দর্শন পেলেন। রতনে রতন চেনে। হযরত আজান গাছী (র.) ভাব জগতে কাছে টানলেন হযরত আবু আলী আক্তার উদ্দীনকে। তুলে দিলেন তাঁর হাতে হাক্কানী দর্শন। এই দর্শনকে আঁকড়ে ধরে শুরু হয় তাঁর সাধনার জীবন। অতঃপর ১৮৯৫ সনের দিকে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। গভীরভাবে নিমগ্ন হলেন সাধনায়। বেশির ভাগ সময় তাঁকে একাকী অথবা কবরস্থানে পাওয়া যেত। ওই সময় নারায়নপুর গ্রামে প্রায় ৫-৬ বছর অবস্থান করেন। যখন তাঁর বয়স ৩৫-৩৬ বছর তখন তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়। তিনি সংসারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হলেন।
কোন কিছুই তাঁকে আকৃষ্ট করে দুনিয়াদারির মধ্যে নিমজ্জিত করে রাখতে পারেনি।
জ্ঞানের রাজত্বে বিচরণের জন্য ভাবের সাগরে ডুব দিলেন তিনি। আল্লাহর সন্ধানে তিনি মুসাফির হয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন স্থানে গাছের নিচে কিছু কিছু সময় অবস্থান করেন এবং রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। দুনিয়াদার মানুষকে কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ্র দিকে আকৃষ্ট করাই সাধনার প্রথম স্তরে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি কঠোর সাধনা ও রিয়াজতপূর্ণ জীবনযাপন প্রণালী দ্বারা সমাজে আদর্শ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
হযরত মাওলানা আজান গাছী (র.)-এঁর খেলাফত প্রাপ্ত হলেও শাহ্ সূফী আহসান উল্লাহ্ (রঃ) (মুশুরী খোলার শাহ্ সাহেব নামে খ্যাত) ও হযরত শাহ্ আলী বোগদাদী (র.) এঁর সঙ্গে তাঁর এক গভীর আধ্যাত্মিক যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
নদীর কিনার ধরে হাটা, কবরস্থানে অবস্থান সর্বোপরি সারা রাত্রি দু-পায়ের উপর ভর করে বসে থাকা অবস্থায় নিজ খেয়ালে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তাঁর সাধনা জীবনের অন্যতম দিক।
গাছে ফুল ফুটলে তা যেখানেই হোক না কেন (শহর, গ্রাম, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি) মৌমাছি, মাছি আর ভ্রমর যেমন সেখানে যাবেই ফুলের স্বাদ গ্রহণ করতে, ঠিক তেমনি সূফী সাধকের আবির্ভাব ঘটলে সাধারণ মানুষ, ধর্মানুরাগী ও সমাজের অবহেলিত মানুষেরও জমায়েত সেখানে হবেই। সাধারণ মানুষ ছুটে যাবে তাদের দৈনন্দিন সমস্যার সুরাহার জন্য আর ধর্মানুরাগী যাবে আশ্রয়স্থল নির্ধারিত করার স্বপ্নে। অপরদিকে সমাজের অবহেলিত মানুষ যাবে সমাজের কাছে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য। ঘুরতে ঘুরতে সূফী সাধক আক্তার উদ্দীন আসলেন কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়াচর থানার কান্দুলিয়া নামক গ্রামে। তাঁকে ঘিরে জমায়েত হতে থাকে সাধারণ মানুষের বহর। এক আম গাছের নিচে কুঁড়ে ঘরে বাঁশের মাচার উপর তাঁর অবস্থান। দিনে-রাতে হাজার মানুষের আনাগোনা। ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর কামালিয়াত। খ্যাত হয়ে পড়েন ‘কান্দুলিয়ার মৌলভী’ নামে। এভাবেই চলে যায় দীর্ঘ ১২ বছর। যে যায় খালি হাতে ফিরে না। ত্যাগের আদর্শে চলতে থাকে ইসলাম প্রচার মানবতার কল্যাণে।
সূফী সাধক আক্তার উদ্দীন-এঁর সাধনার বয়সকাল ছিল প্রায় ৮৫ বছর। সাধনার এই জীবনকালে তিনি তাঁর অনুসারীদের মাঝে সত্যের পথ ও ত্যাগের মাধ্যমে সত্যের পথ ধরে চলার বাস্তব দিকগুলো তুলে ধরেছিলেন। সৎ স্বভাব আর ত্যাগের মাধ্যমে মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন তাঁর অনুসারীদের মাঝে, যাতে পরবর্তীতে তাঁরাও সমাজে একই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
ধর্ম মানবতার জন্য – এ আদর্শ তাঁর কর্মে, চলাফেরা সব কিছুতেই প্রকাশ হয়ে ঝড়ের বেগে প্রবাহিত হতে লাগল বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে। তাঁর চাঁদোয়ার নীচে জড়ো হতে থাকলো মুক্তি পাগল কিছু যুবক যাঁরা আজও সাধনার জগতে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরই আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে। তন্মধ্যে সুলতানুল আউলিয়া আলহাজ্ব হযরত শাহ্ কলন্দর সূফী খাজা আনোয়ারুল হক্ রওশন জমির মাদ্দা জিল্লাহুল আলী ছিলেন অন্যতম যিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন চান্দপুর শরীফে। সূফী সাধক শাহ্ আবদুর রহমান সব সময় সূফী সাধক আক্তার উদ্দীনের সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন। তার একটাই আর্জি ছিল সূফী সাধক আক্তার উদ্দীনের নিকট; তিনি যেন তাঁর মুর্শিদের আগেই ইন্তেকাল করেন। বাস্তবে সেটাই ঘটেছিল। তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আগরপুর গ্রামে।
সূফী সাধক আক্তার উদ্দীন প্রতিদিন ফরিদপুর গ্রাম থেকে হেঁটে বাজিতপুর থানার সরারচর বাজারে আসতেন। নিঃশব্দে সামনের দিকে হেঁটে যেতেন তিনি। তাঁর পিছনে হাঁটতো ভক্তরা। কোনো শব্দ নেই, কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ করবার সময় তাঁর নেই। রাস্তার বাইরে, কিছুই দেখতেন না তিনি। ফসলের ক্ষেত, চাষীদের আনাগোনা, ঘর গৃহস্থীর নিত্য জীবন কোনও দিকে তার নজর থাকতো না। তিনি পথ চলতেন আপন মনে। প্রতিদিন প্রায় চব্বিশ মাইল পথ হাঁটতেন তিনি। তাঁর এই ক্লান্তিহীন হাঁটার দৃশ্য রাস্তার দু’পাশের মানুষ সশ্রদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে দেখতো। কারণ, তাঁর এই হাঁটা হঠাৎ একদিনের প্রয়োজন মেটাতে ছিলো না। এই-ই ছিলো জীবনকর্ম। সাধনার কর্ম।
ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের কুলিয়ার চরের ফরিদপুর গ্রামের নিভৃত পল্লীর অফুরন্ত সবুজের মেলায় তিনি নিজেকে খুঁজে ফিরছিলেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-হেমন্তেরপ্রতিটি প্রভাতেই নেমে পড়ছেন ছাব্বিশ মাইল পথ অতিক্রমে। সাধনার এই কঠিন পথ তিনি ধরে রেখেছিলেন মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত। পেশা জীবন, সংসার জীবন, আত্মীয়-পরিজন – কোনো কিছুই তাঁকে মোহাবিষ্ট করেনি। সংসারের চাকায় পিষ্ট হয়নি তাঁর জীবন জিজ্ঞাসার অসীম জ্ঞানক্ষুধা। কারণ তিনি জেনেছিলেন জ্ঞানই সত্য বাকি সবই মোহ-মায়া।
দীর্ঘ চব্বিশ মাইল হাঁটার পথে তিনি ক্ষুধার্ত হয়েছেন কিংবা কোথাও বিশ্রাম নিয়ে খাদ্যগ্রহণ করেছেন এমনটা প্রত্যক্ষদর্শীদের নজরে নেই। তবে সরারচর পোষ্ট অফিসের সামনে একটি কাঁঠাল গাছের নিচে তিনি বসতেন। চা খেতেন। পোষ্ট অফিসের কর্মচারীদের প্রতিদিন তারিখ ও সময় জিজ্ঞাসা করতেন। সরারচর পোষ্ট অফিসের সকল কর্মচারীরা তাঁর সান্নিধ্যে আসেন। উপস্থিত জনসাধারণ, ভক্ত, আশেকানদের কথা শুনতেন; তারপর এক সময় উঠে রওনা দিতেন আবার ফরিদপুর গ্রাম অভিমুখে। দিনের হাঁটা শেষ করতেন তাঁর আস্তানায় এসে। সামান্য টিনের বাংলাঘর (কাছারি ঘর), তারই বারান্দায় দু’পায়ের উপর বসে রাত পার করতেন। উঠানে, আঙ্গিনায় শত শত মানুষ বসে থাকতো। তিনি বসে থাকতেন দুই হাঁটুর মাঝে নমিত মাথায়। কথা বলতেন আপন মনে, কার সাথে কেউ জানে না।
সূফী সাধক আক্তার উদ্দীন ১৯৮৩ সালে ইন্তেকাল করার ৩/৪ বছর আগে যখন ফরিদপুর হতে সরারচর বাজার পর্যন্ত তিনি হাঁটতেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ১০৭/১০৮। তাঁর বয়সের কথা চিন্তা করে ভক্তরা একটা রিক্সা আনেন এবং তাঁর সমীপে আর্জি পেশ করেন রিক্সায় উঠে যাতায়াত করার জন্য। সূফী সাধক এই আর্জি গ্রহণ করেন। অতঃপর প্রতিদিন তিনি রিক্সায় উঠে বসলে ভক্তরা রিক্সা টেনে টেনে নিয়ে যেতেন। বেশির ভাগ সময়ে পথিমধ্যে ডুমরাকান্দার বাজারে চা খেতেন এবং কিছু সময় ব্যয় করতেন এই বাজারের আশেপাশে।
সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার আগে যখন তাঁর ভক্তদের নিয়ে ফরিদপুর গ্রামে পৌঁছাতেন তখন আরম্ভ হতো আর এক মহোৎসব। সরকার বাড়িতে বৈঠকখানা ঘরটিই ছিল সূফী সাধকের দরবার। বারান্দায় তিনি বসতেন। টিনের ঘর। ভিতরে ছিল একটা চৌকি পাতা। কোন সময় বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন মনে করলে অথবা ভক্তদের মধ্যে থেকে দূরে থাকার প্রয়োজন মনে করলে ঐ চৌকিতে শুয়ে বিশ্রাম নিতেন। অবশ্য এক সঙ্গে ৪ ঘন্টার বেশি কোনদিনই তিনি বিশ্রাম নেননি তাঁর সাধনা জীবনে। এছাড়াও কোনো কোনো সময়ে বারান্দায় যেখানে তিনি বসতেন, সেখানে মাতৃগর্ভে শিশুরা যেভাবে ঠিক একই ভাবে তিনিও ওই বসার জায়গায় শুয়ে বিশ্রাম নিতেন। তাঁর বসার জায়গায় বিছানো থাকতো কাঁথা, যা ছিল তাঁর আসন।
বারান্দা ছিল উঠান হতে খুব বেশি হলে ছয় ইঞ্চি উঁচু। বাংলা ঘরের সামনের ছাঁচে দুটা ইট একত্রে রাখা থাকত। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে পৌঁছে তিনি সেই ইটের উপর দাঁড়াতেন আর ভক্তরা তাঁর পায়ে পানি ঢালা আরম্ভ করত। ওই পানি ভক্ত ও মকসুদিরা হুড়াহুড়ি করে পান করত আর কেউবা গায়ে মাখত, যার যার নিয়ত করে এবং অপার মহিমা এই যে বেশির ভাগ লোকের সৎ নিয়তগুলো পূরণ হতো। তাই প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া অনুধাবন করা খুব কঠিন যে, সূর্য অস্তের সময়ে এই দরবারে প্রতিদিন কী দৃশ্যের অবতারণা হতো।
অতঃপর পা ধুয়ে বারান্দায় তাঁর আসনে উঠার সময় ভক্তদের মাঝে প্রতিযোগিতা শুরু হতো কে কার গামছা দিয়ে পা-মুছিয়ে দেবে। পা-মুছিয়ে দেয়া পর্যন্ত তাঁকে একটা শিশুর মত মনে হতো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন নির্বিকার। আসনে দু-পায়ের উপর উবু হয়ে বসতেন। তখন চতুর্দিকে আগরবাতি ও মোমবাতি জ্বালিয়ে পরিবেশটাকে ভাবগম্ভীর করে তুলতো ভক্তরা। সবাই উঠানে বসে পড়ত। তখন আরম্ভ হতো তাঁর তাত্ত্বিক আলোচনা। কার সঙ্গে তিনি আলোচনা করতেন একমাত্র তিনিই জানেন। তবে ভক্তদের মধ্যে যারা একনিষ্ঠভাবে শুনতেন, তারা জ্ঞান অন্বেষণের পথ পেয়েছেন। যখন কোন ভক্ত বা মকসুদি কোন জিনিস তাঁর সামনে নজরানা হিসেবে দিতেন, তখনই দেখা মাত্র উপস্থিত সবার মধ্যে তা বিলি করে দিতেন। যদি কারো আনা খাবার পছন্দ হতো তাহলে অনেক সময় তিনি তিন আঙ্গুলের সাহায্যে তিনবার কিংবা সাতবার মুখে তুলে খেতেন এবং বাকীটা ভক্তদের দিতেন। সারারাত্রি একইভাবে কাটাতেন। মাঝে মাঝে সারারাত্রির মধ্যে ১/২ কাপ চা খেতেন। ফজর পর্যন্ত চলতো এভাবে। অতঃপর আবার হাঁটা শুরু হতো।
তিনি ভক্তদের আনিত ভোগ্য সামগ্রী তাৎক্ষণিক ভাবে উপস্থিতিদের মাঝে বিলিয়ে দেবার হুকুম দিতেন। একজন মানুষ তাঁর জ্ঞানজগতের অন্বেষায় কতখানি সচেতন হলে মাত্র তিনটি শব্দের মধ্যে বেঁধে দিতে পারেন তাঁর ভাষা ব্যবহার শক্তিকে। ‘আয়েন- বয়েন-যাওন’ – এর বাইরে কথা বলাকেও তিনি হয়তো শক্তির অপচয় বলেই মনে করতেন। তিনি জ্ঞান জগতের অসীমতায় এতই বিলীন হয়েছিলেন যার জন্য জ্ঞানহীন জগতে অনর্থক বাক্য ব্যয়ের অপচয় থেকে নিজেকে রক্ষা করা ছিল তাঁর শরিয়তের বিধান।
প্রতি ওয়াক্তে আজান হতো। সবাইকে পাশের ঘরে উঠানে নামাজ পড়ার তাগিদ দিতেন। কিন্তু কেউ তাঁকে স্বশরীরে নামাজ পড়তে দেখেননি। তাই অনেক শরীয়তি মানুষের কাছে সন্দেহ জাগে। তারা সূফী সাধকের বিরুদ্ধে চক্রান্তে মেতে ওঠে। তারা ফতোয়া দিতে আরম্ভ করলো, এমনকি ‘কাফের’ আখ্যা দিতেও দ্বিধাবোধ করলো না সূফী সাধককে। কিন্তু তিনি নিশ্চুপ। তাঁর ইসলাম ধর্মের মর্মের প্রতি আহবান এতে বাধাগ্রস্থ হয়েছে কিন্তু থেমে থাকেনি।
শরীয়ত চর্চায় যে বিদ্যা লাভ করা যায় তা ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিজাত, গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ বিদ্যা আর মারিফাত সাধনার সাধক যে জ্ঞান লাভ করেন তা হৃদয়জাত জ্ঞান, অতীন্দ্রিয় জ্ঞান এবং প্রজ্ঞাজাত দিব্যজ্ঞান। শরীয়ত চর্চার পর মারিফাতের এই জ্ঞানের উপর সাধক যখন অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন তা লক্ষ্য করলে মনে হয় সাধক শরীয়ত উপেক্ষা করছেন। সূফী সাধক আক্তার উদ্দীন এঁর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল ঠিক তাই।
তথাকথিত শরীয়তি আলেম সম্প্রদায় জনসাধারণের কাছে এমনকি তাঁর ভক্তদের মধ্যে ফ্যাসাদ সৃষ্টির জন্য উঠে পড়ে লাগেন। এক শুক্রবার সূফী সাধক ফরিদপুরে তাঁর দরবারে বসে আছেন এমন সময় কতিপয় তথাকথিত আলেম দুপুর ১২টার দিকে তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁর সাথে অবস্থান করতে থাকেন। জুম্মার নামাজের সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তারা সূফী সাধককে প্রশ্ন করলেন – হুজুর আপনি জুম্মা’র নামাজ পড়লেন না। আমরা তো আপনাকে পরীক্ষা করার জন্য এসেছি। তাহলে আপনি কি শরীয়ত মানেন না? হুজুর নিশ্চুপ। ভক্তদের মাঝে গুঞ্জন। দরবারে আনুমানিক ৩০০/৪০০ জন ভক্ত-মকসুদি ছিল। সবাই পরিস্থিতি দেখছে। এইভাবে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় কেটে গেল। দেখা গেল দু’জন ভক্ত মুসুল্লি গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়ে দরবারের দিকে আসছেন একজনের মাথায় ধামাতে ভাত ও অন্যজনের মাথায় হাঁড়িতে তরকারি। তারা দরবারে এসে প্রথমেই সূফী সাধকের কাছে ক্ষমা চাইলেন দেরি হওয়ার জন্য। ভক্তদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কি? তাদের মধ্যে একজন বললেন-হুজুর আমাদের সাথে নামাজ আদায় করার পর হুকুম দিলেন-‘দরবারে মেহমান আছে কিছু খাবার আনলে’-এই কথা বলে চলে আসেন। মেহমানদের জন্যে আমাদের খাবার আনতে গিয়ে একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে। তথাকথিত আলেমরা হতবাক। সূফী সাধক তাদেরকে খাওয়ায়ে বিদায় দিলেন। এমন জ্বলন্ত প্রমাণ পাবার পরও তাঁকে সরারচর যাওয়ার রাস্তায় বহুবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে।
সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দীন তাঁর ৮৫ বছরের সুদীর্ঘ সাধনা জীবনে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন ব্যক্তিজীবনে সত্য বলা ও সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ‘ধর্ম মানবতার জন্য, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের জন্য নয়’ – এই মন্ত্র ধারণ করেই তিনি হয়েছিলেন ধার্মিক। মহানবী (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁর জীবনাদর্শনই তাই মূর্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর গোটা জীবনে।
এই পৃথিবীতে যে সমস্ত সাধক সত্য ও মানবতার জন্য নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এবং আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদেরকে মৃত মনে করা উচিত নয়। কেননা তাঁরা একমাত্র আল্লাহরই উদ্দেশ্যে তাঁদের নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
তাই তাঁরা শারীরিকভাবে পর্দার অন্তরালে গেলেও আধ্যাত্মিকভাবে চিরঞ্জীব থাকেন। দুনিয়ায় অধিষ্ঠিত মানুষ ধন-দৌলতকে প্রাণের মতই ভালবাসে এবং সেই কারণে মৃত্যুকে অত্যন্ত ভয় করে অপর পক্ষে কুরআনিক মুসলিম সাধকগণ আল্লাহর পথে যাত্রা শুরু করে এমন এক অফুরন্ত নিয়ামতের ভান্ডারের অধিকারী হন যার সমকক্ষ কিছুই হতে পারে না। সেই রূপ অফুরন্ত ভান্ডারের অধিকারী সূফী সাধক আক্তার উদ্দীন কালোত্তীর্ণ এক মহাপ্রাণ।
সূফী সাধকের সুযোগ্য উত্তরসূরী প্রধান খলিফা সূফী সাধক আনোয়ারুল হক তাঁরই নির্দেশে সাধারণ মানুষ ও ভক্তদের জন্য হাক্কানী ওজায়িফ, হাক্কানী তরীকার প্রচার ও প্রসার ঘটান দ্বীন-দুনিয়ার শান্তি ও মঙ্গল হাসিল করার জন্য। তাঁর আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মানসে তিনি সারা বাংলাদেশে এবং বহিঃবিশ্বে মানবতার সেবায় হাক্কানী খানকা/দরবার শরীফ/আস্তানা শরীফ একের পর এক শহর/জেলা/গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করেন যা আজো অব্যাহত আছে।

সূফী সাধক আবু আলী আক্তার এঁর কয়েকটি মূল্যবান বাণী

* তুমি প্রতিটি কর্মের মধ্যে সত্যকে অন্বেষণ কর তাহলে তোমার ইবাদতের দ্বার খুলে যাবে।
* ঈমানদার সব সময় তার আল্লাহ্কে স্মরণ করে, দুঃখ শোকে ধৈর্যশীল।
* তোমার আল্লাহ্কে স্মরণ কর, মুনাফিক আর মুশরিক না হওয়ার প্রচেষ্টায় রত থাক।
* সকল কর্মের প্রারম্ভেই তুমি তোমার আল্লাহ্কে অবশ্যই স্মরণ করিও।
* নিজের চোখকে আয়ত্তে আনো, সাধনার পথে এগিয়ে যাও।
* জ্ঞান অর্জনে বই-কেতাব হতে মানুষ-কেতাব উত্তম।
* যে ব্যক্তি সর্বদা তার আল্লাহর নিকট মার্জনা ভিক্ষা করে সে কখনো বিপদগ্রস্ত হয় না।
* সে’ই ব্যক্তি স্বাধীন যে নিজের নফসকে আল্লাহর নির্ধারিত রাস্তায় বশে এনেছে।
* ক্ষমা প্রদর্শন ভদ্রতার নিদর্শন।
* যে মুর্শিদকে দর্শন করতে সচেষ্ট হয়েছে তার হজ্বের যাত্রাও শুরু হয়েছে।
* তোমার কর্মের মধ্যে প্রতারণা করিও না, প্রতারণা সব অপরাধকে বাড়িয়ে তোলে।
* নিজেকে চেনার চেষ্টা কর। যতই নিজেকে চিনবে ততই আল্লাহর নিকটবর্তী হবে।
* প্রত্যাশাহীন কর্মই ধার্মিক হতে সহায়তা করে ও আল্লাহ্ প্রাপ্তির সহায়ক হয়।
* ইন্দ্রিয় সমূহের নিকট আগমনকারী সকল বিষয়বস্তু ও ইন্দ্রিয় সমূহের দ্বারা ঘটিত সকল
কর্ম সূক্ষ্মভাবে দর্শন করার মাধ্যমেই ঘটে আত্মদর্শন।
* সত্য দেখার আগে সত্য নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা করা শ্রেয়।
* আত্মকর্ম বিশ্লেষণে ব্রত নিলে সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যাবে।
* বিদ্যা, বুদ্ধি, বল বিক্রম, পান্ডিত্য গর্ব দোষে খর্ব হয়।