Biography of Sufi Saint Sheikh Abdul Hanif

চিরঞ্জীব সূফী সাধক শেখ আব্দুল হানিফ

20190830_222817

বাংলা ১৩৫৩ সনের চৈত্র মাস ও ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে। অবিভক্ত ভারত বর্ষের পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার, সোনারপুর মহকুমার, চাকবেড়িয়া গ্রামে আবির্ভাব হয় সূফী সাধক শেখ আব্দুল হানিফ-এঁর। মাতা – সাজেদা বেগম, বাবা – শেখ আব্দুল হামিদ। মাতৃকূল ছিলেন সূফী সাধক হযরত আজানগাছি-এঁর সাথে এবং পিতৃকূল সূফী সাধক গাজিবাবা (ঘূটিয়া শরীফ)-এঁর সাথে সম্পর্কিত। ৬ ভাই ও ৬ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সেজ ভাই, সকলেই তাঁকে ডাকতেন ‘সেজদা’ বলে।
চব্বিশ পরগণার চাকবেড়িয়ায় অবস্থিত কালিকাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ১৯৬৪ সনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর বাবা চাকবেড়িয়াতে ফিরে যান বিষয় সম্পত্তির সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা করে ফিরে আসবেন বলে কিন্তু ১২ আগষ্ট ১৯৬৪-এ তিনি লোকান্তরিত হন এবং চাকবেড়িয়াতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। বাবা লোকান্তরিত হবার পর মা ও ছোট ভাই-বোনদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তিঁনি। শুরু হয় সংসারযুদ্ধ। মা আর ভাইবোনদের দায়িত্ব পালন করলেও নিজের পড়াশুনা ঠিকই চালিয়ে গেছেন। দিনের বেলা কর্ম আর রাতে নাইট স্কুলে পড়াশুনা। ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ১৯৬৮-এ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন ১৯৭৪-এ। যদিও ১৯৭২-এ শেষ হবার কথা- স্বাধীনতা যুদ্ধের কারনে তা পিছিয়ে যায়। মাঝে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো কোম্পানী তে কর্মজীবন শুরু করেন। সারারাত কাজ করে সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে ফিরতেন। ১৯৭৩ এর ২০ জুলাই আনোয়ারা বেগম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে ঢাকেশ্বরী কটন মিল এ লেবার অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৪ এ সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর দর্শন লাভ করেন ধানমন্ডির ঝিগাতলা দরবারে এবং হাক্কানী ধারার সাথে নিজেকে একাত্ম করেন। ১ বৈশাখ ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ, ১৯৭৭ এর ১৪ এপ্রিল খ্রিষ্টাব্দে – সূফী সাধক আনোয়ারুল হক তাঁকে ‘শাহ সূফী’ খেতাবে ভূষিত করেন। ১৯৭৭ এ ঢাকেশ্বরী কটন মিলের দায়িত্ব ছেড়ে বিআইডিএস এ প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৭ এর ৩০ ডিসেম্বর তাঁর মহীয়সী মা সাজেদা বেগম লোকান্তরিত হন।
এরই মধ্যে ‘পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট’ (কর্মী ব্যবস্থাপনা) ডিপ্লোমা ডিগ্রী সম্পন্ন করেন তৎকালীন বিএমডিসি হতে। ১৯৭৯ এ সৌদি আরবের রিয়াদে অবস্থিত ‘ইমাম ইউনিভার্সিটি’-তে কুরআন গবেষণা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়ীত্ব পালন করে ১৯৮৬ এর আগষ্ট মাসে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮৭ সনের ফেব্র্রুয়ারি মাসে সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর নির্দেশে খুলনার দরবার প্রতিষ্ঠা করেন। খুলনায় দরবার প্রতিষ্ঠার দিন সূফী সাধক আনোয়ারুল হক তাঁকে সাদা পোষাক, লুঙ্গি, গেঞ্জি, উড়নি পড়িয়ে দেন। তারপর থেকে সূফী সাধক শেখ আব্দুল হানিফ অন্য কোন পোষাক পরিধান করেননি। বাংলা ১৩৯৫ সনের ১৩ মাঘ, ১৯৮৮ খ্রীষ্ঠাব্দের ২৬ জানুয়ারী সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর নির্দেশে মিরপুর আস্তানা শরীফ এর উদ্বোধন হয় এবং আস্তানা শরীফের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। দায়িত্ব ও কর্তব্যে নিষ্ঠা, লক্ষ্যকেন্দ্রিক পথচলায় দৃঢ়তা দেখে সূফী সাধক আনোয়ারুল তক তাঁর শিষ্যকে সকল ভক্তদের মধ্যে এক নম্বর হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ‘কর্ম-মানবতা-শান্তি’ এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে ১৯৯০ সনে সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর নির্দেশে হাক্কানী মিশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৩ সনে হাক্কানী মিশন বিদ্যাপীঠ (বর্তমানে বিদ্যাপীঠ ও মহাবিদ্যালয়) এবং মাসিক বর্তমান সংলাপ (বর্তমানে সাপ্তাহিক বর্তমান সংলাপ) পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং নিজে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন যা ২৭ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। তিঁনি ২০০৩ সালে বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফ (বাহাখাশ) প্রতিষ্ঠা করেন যার অধীনে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ৫৫টি কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। হাক্কানীর বিষয় সম্পত্তির সুষ্ঠ রক্ষণাবেক্ষণে ‘হাক্কানী ট্রাস্ট’ গঠন করেন ২০০৮ সালে। ‘সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সত্যের সাথে একাত্মতা’-এই আহবানে ২০১৭ সালে তাঁর নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সত্যব্রত আন্দোলন। পাশাপাশি ‘হাক্কানী স্কুল অব সুফীজম এ্যন্ড থট’ নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা বাংলায় এবং বিশ্বের বহু দেশে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, কানাডা, ওমান, ইউএই, জর্ডান, ইরাক, তুরস্ক, ভারত এবং সর্বশেষ ভ্রমন করেন চীন। সূফী সাধকগণ (সত্যামানুষ) ধূলির ধরাধামে আসেন, কর্ম-মানবতা-শান্তি’র পথ মানবজাতিকে প্রদর্শন করেন আর সময় হলে নিজেদের পর্দার অন্তরালে যান মহামিলনে। এমনই এক মহাপ্রাণ, চিরঞ্জীব সূফী সাধক (সত্যমানুষ) শেখ আব্দুল হানিফ, ৫ শ্রাবণ ১৪২৬, ২০ জুলাই ২০১৯, শনিবার সকাল ৭টায় লোকান্তরিত হন এবং শায়িত হন মিরপুর আস্তানা শরীফে। তিঁনি সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর কাছে আর্জি পেশ করেছিলেন যে তিঁনি সারাজীবন ছাত্র থাকবেন, যা সুফী সাধক আনোয়ারুল হক গ্রহণ করেন। ‘ধনবান হও, প্রকাশিত হয়ো না’ – নিয়ন্ত্রণের শিখরে অবস্থানরত সাধককূলের প্রকাশ ঘটে অতি সূক্ষভাবে, যা সহজে সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয় না। মহান সূফী সাধক শেখ আব্দুল হানিফ ছাত্র হিসেবেই জীবনযাপন করেন এবং তাঁর ভক্ত বৃন্দের মাঝে অসংখ্য পাথেয় রেখে গেছেন যা ধরে এগুলে চিন্তা জগতেই হবে তাঁর প্রকাশ।

সূফী সাধক শেখ আব্দুল হানিফ এঁর কয়েকটি মূল্যবান বাণী –

 

* কষ্ট ও ক্ষতির পর মানুষ বিনয়ী ও জ্ঞানী হয়।

* মুর্শিদকে দর্শন ও স্মরণের মধ্যেই রয়েছে দরবারের আশেকানদের পরম প্রাপ্তি।

* তুমি তোমার আল্লাহর সাথে সংযোগ রক্ষার্থে প্রতিদিন তাঁকে কমপক্ষে এক হাজার একবার স্মরণ কর।

* দৈনন্দিন প্রতিটি কর্মের মাঝে তোমার আল্লাহকে প্রতিষ্ঠিত কর।

* ঘুম ভাঙ্গার পর চোখ মেলার আগেই তোমার আল্লাহকে স্মরণ কর।

* নিঃসন্দেহ সম্পর্ আর সশ্রদ্ঃধ ভালোবাসা তোমার আল্লাহ প্রেমের প্রথমিক উপাদান।

* তুমি যতই তোমার প্রতিটি কর্মের বিশ্লেষণ করবে ততই তোমার আত্মিক উন্নতি হবে।

* কখনই নিজেকে অপরের সঙ্গে তুলনা করো না, যদি কর তাতে তুমি নিজেকেই অপমানিত করলে – যা আল্লাহ ভালোবাসেন না।

* তোমার আল্লাহর হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মধ্যেই রয়েছে সার্বিক শান্তি।

* একজনের কথা অপরজনের কাছে সঠিক প্রকাশ করতে না পারলে তুমি নিজেই মিথ্যাবাদী হবে।

* চোখ থাকতে অন্ধ, কান থাকতে কালা, মুখ থাকতে বোবা হয়ে যে আল্লাহর হুকুম পালন করে সেই সর্বোত্তম।

* সংস্কার মুক্ত হয়ে সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠিত করার পথে পা বাড়াও, তুমি তোমার আল্লাহর রহমত হবে বঞ্চিত হবে না।

* সত্য বলুন – সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হোন, নিজে বাঁচুন, দেশ ও জাতিকে বাঁচান।

* সমর্পন করা সহজ কিন্তু আত্মসমর্পণ করা অত্যন্ত কঠিন।

* সুজন, কুজন আর আপনজন – এই নিয়ে মোর জীবনযাপন।

* সত্যমানুষ হোন – দেশ ও জাতির কল্যাণ হবেই হবে।

* পাশাপাশি চলো বন্ধু হতে পারো।

* মানুষ নিজের সাথে নিজেই বেশি প্রতারণা করে। জীবন একটাই, সুতরাং নিজের সাথে নিজের প্রতারণা আর নয়।